Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০
teletalk.com.bd
thecitybank.com

ভালো নেই ১৩০ বছরের ‘শ্যামাসুন্দরী’

প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২৩, ২২:১৯

ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল

রিশিতা জাহান: জনসচেতনতার অভাব আর সংস্কার ব্যবস্থা না থাকায় আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে শ্যামা সুন্দরী খাল। এতে যেমন রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে তেমনি বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

রংপুর মহানগরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া প্রায় ১৩০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খালটি ১৮৯০ সালে তৎকালীন ডিমলার দানশীল রাজা জানকী বল্লভ সেন তাঁর মা 'শ্যামাসুন্দরী’র স্মরণে এ খাল খনন করেছিলেন। শ্যামাসুন্দরীর মতো একটি খাল কেবল রংপুরই নয়, বাংলাদেশেই বিরল। ১৬ কিমি দীর্ঘ এবং স্থানভেদে ৪০ থেকে ১২০ ফুট প্রশস্ত এই খাল পৌর এলাকার উত্তর পশ্চিমে কেল্লাবন্দস্থ ঘাঘট নদী থেকে শুরু হয়ে নগরীর সব পাড়া- মহল্লার বুক চিরে ধাপ পাশারি পাড়া, কেরানী পাড়া, মুন্সী পাড়া, ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, গোমস্তা পাড়া, সেন পাড়া, মুলাটোল, তেতুলতলা, নূরপুর, বৈরাগিপাড়া হয়ে মাহীগঞ্জের কেডি ক্যানেল স্পর্শ করে মিশেছে খোকসা ঘাঘট নদীতে।

জানা যায়, সে সময় এ অঞ্চল জুড়ে পয় নিষ্কাশনের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ম্যালেরিয়াবাহী মশার উপদ্রব ছিল খুব বেশি। সেই মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েই সে সময় মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাজমাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। পরে মাতৃ শোকে বিহ্বল রাজা জানকী বল্লভ এই মরণব্যাধীর হাত থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করতে জলাবদ্ধতা আর ম্যালেরিয়া দূর করার জন্যই মায়ের স্মরণে এ খাল খননের উদ্যোগ নেন। খালের নামকরণ করা হয় ‘শ্যামাসুন্দরী খাল’।

কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আজ থেকে ১৩০ বছর আগে খালটি খনন করেছিলেন রাজা জানকী বল্লভ সেন, কালের বিবর্তন আর জনসংখ্যার আধিক্যে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের পরিবর্তে খালটি পরিণত হয়েছে মানুষের মল মূত্র আর আবর্জনার ভাগাড়ে।

দখলকারীদের কবলে পড়ে সামান্য এক ড্রেনে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৪শত ৮২জন দখলদারের কাছে জিন্মি হয়ে পড়েছে খালটি।খালের অনেক অংশই সংলগ্ন মানুষজন তাদের দখলে কোথাও কোথাও অট্টালিকাও গড়ে তুলেছে। নিয়ম-নীতি না মেনে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠছে। বর্তমানে খালটির ময়লায় পূর্ণ হয়ে গেছে। সংস্কার না করার কারণে মশার আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। ৪০ থেকে ১২০ ফুট প্রশস্ত খালটি বর্তমানে ৮ থেকে ১০ ফুটে পরিণত হয়েছে। ভরাট ও দখল হয়ে যাচ্ছে খালটি। খালের জীর্ণদশা, ময়লা, আবর্জনা ও দূষণে কালো হয়ে গেছে পানি। আবর্জনার স্তুপে বর্তমানে ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবাহ। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়া ও খালটির সঙ্গে আশপাশের বাড়ি-ঘরের পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ থাকায় দুর্গন্ধের কারণে খালটির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শ্যামা সুন্দরী খালে কালচে পানিতে ভাসছে আবর্জনা। দুইপাশে বাসা-বাড়ির বর্জ্যের স্তুপ। এখন দখল হয়ে সরু হয়ে গেছে এর আকার। খালের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা। আর একটু বৃষ্টিতেই খালে উপচে পড়ে পানি। শহরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

এখন একটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় রংপুর শহর। নগরীর শতাধিক পাড়া-মহল্লার প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে যায়। নগরীর কোনো কোনো জায়গা কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়। সামান্য একটু বৃষ্টিতে রংপুর নগরী এভাবে ডুবিয়ে যায়।নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এক সময় যে খাল খনন করা হয়েছিল, সেই শ্যামা সুন্দরী খালটি একটু বৃষ্টিতে উপচে পরে তা এখানকার মানুষ কল্পনা করতে পারে না। দখল-দূষণ আর ভরাট হয়ে এ খালের এমনই অবস্থা যে এটি এখন রংপুর নগরবাসীর দুঃখে পরিণত হয়েছে। 

শ্যামাসুন্দরী খালের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের ২৬শে আগস্ট জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নদী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শ্যামাসুন্দরীকে পুনরুজ্জীবিত করতে ৩টি ধাপে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সীমানা নির্ধারণ, পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত কর্মসূচির আওতায় ওই বছর ২৩শে অক্টোবর নগরীর চেকপোস্ট এলাকায় সীমানা নির্ধারণ কাজের উদ্বোধন করা হয় এবং পরবর্তীতে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে ২০২০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ১১ ঘণ্টার ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রংপুর নগরীর বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মালামাল, খাদ্যশস্যসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদীপশুসহ আশ্রয় নেয় নগরীর স্কুলগুলোতে। দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। এরপরেও রংপুর সিটি করপোরেশনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা শ্যামাসুন্দরী খাল নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ২০২১ সালের ৩রা অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আর এতে ২০২০ সালের মতো নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে পরপর দুই বছর জলাবদ্ধতায় ভোগেন রংপুরবাসী। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পর ২০২১ সালের শেষের দিকে রংপুর সিটি করপোরেশন শ্যামাসুন্দরী নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বিকন ডিজাইন স্টুডিও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কচ্ছপের গতিতে কাজ করছে সেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ফলে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জমেছে নগরবাসীর মাঝে।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৩০ বছর আগে কীভাবে পানি প্রবাহিত হতো, ঘাঘট থেকে শ্যামাসুন্দরীতে কেন পানি প্রবাহিত হচ্ছে না, কোথায় কোথায় পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া শ্যামাসুন্দরী খালের দূষণ অন্যান্য নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে নদীর মাছসহ নদী কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে হলে এতে পানি লাগবে। 

রংপুরের সচেতন মানুষ মনে করেন, শ্যামাসুন্দরী সেই যৌবন ফিরিয়ে আনতে সরকারের সুনজর প্রয়োজন । তাছাড়া সংস্কার কাজের অগ্রগতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতার দিকেও নজর দিতে হবে।

লেখক
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা, ২৬ মার্চ (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম) //এমএফ

 


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ